কুরুক্ষেত্র:

3 minute read
0
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যেদিন অভিমন্যু মারা গেল, সেদিন অর্জুন অন্যদিকে যুদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিলো। অর্জুনের অনুপস্থিতিতে অভিমন্যুকে হত্যা করা যায় খুবই নির্মমভাবে।

সূর্যাস্তের পর অর্জুন শিবিরে ফিরে শুনতে পেল এক হৃদয়বিদারক সত্য। নিরস্ত্র অবস্থায় তার ছেলে অভিমন্যুকে ঘেরাও করে হত্যা করেছে কৌরব সেনার সাতজন মহারথী। মৃত অভিমন্যুর শরীরকে লাথি মেরে উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিলো কৌরবদের জামাতা জয়দ্রথ। পুত্র অভিমন্যুর মৃত্যুতে শোকাতুর অর্জুনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চরম ক্রোধ ও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে অর্জুন প্রতিজ্ঞা করে বসলো ---- " আগামীকাল সূর্যাস্তের আগে আমি জয়দ্রথকে বধ করবো অন্যাথায় নিজে অগ্নিস্নান নিয়ে নিবো। " 

অর্জুনের এমন ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা শুনে দুই পক্ষেই বেশ হৈচৈ পড়ে গেলো। পান্ডবরা অর্জুনের এহেন প্রতিজ্ঞায় ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলো, কারণ অর্জুন ছিলো পান্ডব পক্ষের মূল শক্তি যাকে ছাড়া এই ধর্মযুদ্ধে জয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। অর্জুন যদি তার প্রতিজ্ঞাপালনে ব্যর্থ হয় তবে সে জ্বলন্ত চিতায় প্রবেশ করে আত্মাহুতি দিবে। এদিকে কৌরবরা অর্জুনের প্রতিজ্ঞা শুনে বেশ খুশিই হয়েছিলো। কোনভাবে জয়দ্রথ কে পরেরদিন লুকিয়ে রাখতে পারলে অর্জুন তাকে বধ করতে পারবেনা আর ফলাফলস্বরুপ তাকে অগ্নিস্নান নিতে হবে।

পরেরদিন অর্জুন তার প্রতিজ্ঞাপালনের জন্য ভয়ংকরভাবে যুদ্ধ শুরু করলো। কৌরব পক্ষের সেনা, রথী, মহারথী সবাইকে পরাস্ত করে সামনের দিকে রথ এগিয়ে নিচ্ছিলো। অর্জুনের পথ আটকে দিতে কৌরবপক্ষের সেনাপতি দ্রোণাচার্যকেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। শত্রুপক্ষে হাহাকার সৃষ্টি হলো। ভীষণভাবে সেনাদের সংহার করে অর্জুন এগিয়ে যাচ্ছিলো জয়দ্রথের খোঁজে। অর্জুনের রথ চালাচ্ছিলেন স্বয়ং বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ। কৌরবদের প্রধান দূর্যোধনের পরামর্শে সেনাপতি দ্রোণাচার্য জয়দ্রথকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখেছিলেন যেন সূর্যাস্তের আগে অর্জুন কোনভাবেই যেন তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করতে না পারে।

সূর্যাস্তের সময় তখন নিকটে। অর্জুন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছিলো। তার মনে হচ্ছিল আর বুঝি প্রতিজ্ঞা পূরণ করা হবেনা। তাকে নিতে হবে অগ্নিস্নান। শত্রুপক্ষ তাকে তাচ্ছিল্য করতে শুরু করলো। হাসাহাসির রোল পড়ে গেল চারিদিকে। অর্জুনকে এমন অবস্থায় দেখে বাকি চার পান্ডবও ভেঙ্গে পড়লো। তখনই শ্রীকৃষ্ণ এক মায়ার রচনা করলেন। তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে ঢেকে দিলেন সূর্যকে এবং যুদ্ধের ময়দানে আভাস দিলেন যেন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। 

শ্রীকৃষ্ণের মায়াজালে পা দিল শত্রুপক্ষ। সূর্যাস্তের আভাস পেয়ে অতি উৎসুক জয়দ্রথ তার গুপ্তস্থান থেকে ছুটে আসলো অর্জুনের অগ্নিস্নান দেখতে। অর্জুনও তখন সূর্যাস্ত হয়ে গেছে ভেবে গ্লানিতে অগ্নিস্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। জয়দ্রথ যখনই অর্জুনের সামনে এল ঠিক তখনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র সরিয়ে নিলেন। মুহূর্তেই যুদ্ধ ময়দান আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। হুট করে এত আলো দেখে অর্জুন নিজেই হতভম্ব হয়ে গেলো। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন --- " ঐ হলো সূর্য আর এই হলো জয়দ্রথ। উঠাও তোমার গান্ডীব আর চালাও বাণ। করে নাও তোমার প্রতিজ্ঞাপালন। " 

অর্জুন আর দেরি করলোনা। মাটিতে পড়ে থাকা গাণ্ডীব তুলে নিলো আর জয়দ্রথকে লক্ষ্য করে ছুঁড়লো এক অমোঘ বাণ। জয়দ্রথের চোখে মুখে মৃত্যুভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো । কৌরবপক্ষের জয়দ্রথকে বাঁচানোর শত চেষ্টা বিফলে গেল আর অর্জুনের বাণে জয়দ্রথের মস্তক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। অবশেষে সূর্যাস্ত হওয়ার আগেই অর্জুন তার প্রতিজ্ঞাপালন করতে সফল হলো। 

নীতিকথাঃ 

১। আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনের প্রতি পদে পদে অনেক বাধা আসবে। কিন্তু শেষটা না দেখা পর্যন্ত হার মেনে নেওয়াটা চরম বোকামি। 

২। আবেগী হওয়া ভালো কিন্তু আবেগের তাড়নায় এমন কোন প্রতিজ্ঞা করা উচিত নয় যা রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হতে পারে। আর যদি প্রতিজ্ঞা করেই ফেলা হয় তবে সেটা রক্ষার জন্য জীবন বাজি রাখার মত সৎসাহস থাকতে হবে।

৩। অতি উৎসাহী হয়ে কখনো জয়ী হওয়ার আগে বিজয়ের খুশি উৎযাপন করা ঠিক হবেনা। কেননা কখন কে জিততে জিততে হেরে যায় আর কে হারতে হারতে জিতে যায় এটা একমাত্র বিধাতাই ছাড়া কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
...সংগৃহীত 

Post a Comment

0Comments

Please Select Embedded Mode To show the Comment System.*